তিন’শ বছরের প্রাচীন রহস্যময় যুগল বৃক্ষের হাতছানি

লিখেছেন লিখেছেন এফ শাহজাহান ১৯ জুন, ২০১৩, ১২:৩৫:৫৩ দুপুর



তিন’শ বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছে বটগাছটি। শুধু বটগাছ বললে ভুল হবে। বট আর পাকুড় বৃক্ষের দৃষ্টিনন্দন যুগলবন্দী এক রহস্য বৃক্ষ। রাস্তার দুইপাশে ছড়িয়ে পড়েছে গাছটির বিশাল শাখা প্রশাখা। শেকড় বাকড়ে ছেয়ে গেছে পুরো এলাকা। প্রায় তিন’শ বছরের এই বটগাছটি আজও রয়েছে তাজা তরুন আর চিরসবুজ। তিন’শ বছর পার করলেও তাতে যেন বার্ধক্যের ছাপ পড়েনি। আর সে কারনেই এই বটগাছকে ঘিরে রয়েছে নানা মিথ আর রহস্য। প্রশস্ত রাস্তার পাশে এতদিন ধরে দাঁড়িয়ে থাকা বটগাছটিকে ঘিরে নানা রহস্য ঘেরা এসব কাহিনী বংশ পরম্পরায় চলে এসেছে। ঐ গাছের ডালপালা যেমন চারিদিকে বিছিয়ে গেছে, তেমনি সেই সব গল্প কাহিনী আর কল্প গাথাও বছরের পর বছর ধরে ডালপালা গজিয়েছে ।

এসব কারনে বগুড়া আদমদীঘি উপজেলার ছাতিয়ানগ্রামের এই যুগলবৃক্ষ দেখতে আসেন দুর দুরান্তের অনেক পর্যটক। গাছটির বিভিন্ন বিষয় পর্যবেক্ষন করেন ইতিহাস অনুসন্ধানীরা। এসব বিবেচনায় দাবি উঠেছে গাছটিকে প্রাচীন ঐতিহ্যের স্বাক্ষী হিসেবে টিকিয়ে রাখার। এটি একটি মুল্যবান প্রতœসম্পদ হিসেবেও রক্ষনাবেক্ষনের দাবি সচেতন মহলের। হয়তো এমন একদিন আসবে যেদিন এই যুগল বৃক্ষটি বিশ্ব ঐতিহ্যের একটা অংশও হয়ে যেতে পারে। ইতিহাস ঐতিহ্যের অনেক দুর্লভ তথ্য অনুসন্ধানে গবেষকদের জন্যও গাছটি মুল্যবান উপাদান হতে পারে বলে মনে করছেন এলাকার শিক্ষিত জনেরা। অনেকে মনে করেন এই বৃক্ষকে ঘীরে এই অঞ্চলে পর্যটন কেন্দ্রও গড়ে তোলা সম্ভব।

এখনো স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায় এই গাছটিকে ঘিরে রীতিমত পূজা অর্চনা করেন। গাছতলায় হিন্দু সম্প্রাদয়ের মানুষেরা স্থায়ী উপাসনালয় বানিয়েছেন । পুজার পাশাপাশি এই গাছকে ঘিরে হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়েরই নানা কাহিনী প্রচলিত আছে। সে সব কাহিনী আজ থেকে তিন’শ বছর আগে থেকে এই উপমহাদেশের হিন্দু মুসলমানদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক বিরল দৃষ্ঠান্ত হয়ে আছে।

কথিত আছে, বহু বছর আগে এক রাতে এই বটগাছের নীচে কে বা কারা একটি শিব লিংগ রেখে যায়। তখন থেকেই ওই বট-পাকুর যগল গাছের নিচে পূজা অর্চনার প্রচলন হয়ে আসছে। স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন জানান এই গাছ তলায় অনেকবার বট পাকুড় গাছ লাগানো হয়েছে কিন্তু কোন গাছই বাঁচানো যায়নি।

কথিত আরো অনেক ঘটনার মধ্যে থেকে জানা যায়, ১৭০১ খৃস্টাব্দ মোতাবেক ১১২২ বঙ্গাব্দে আদমদীঘির ছাতিয়ানগ্রামে ব্রানকুলে এক কন্যা শিশুর জন্ম হয়। তাঁর পিতার নাম ছিলো আত্মারাম চৌধুরী আর মাতার নাম শ্রী তমা দেবী চৌধুরানী। জমিদার আত্মারাম চৌধুরীর কোন সন্তানাদী না হওয়ায় তিনি স্থানীয় ছতিয়ান গ্রামের মুসলমান পীর দেওয়ানুতুল্লাহর কাছে যান। পীর জমিদার আত্মরামকে সন্তান লাভের আর্শিবাদ করেন এবং পরে তার একটি কন্যা সন্তান জন্ম নেয়। সেই কন্যা সন্তানটি পরবর্তীতে ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবে বলেও পীর সাহেব আশীর্বাদ করেন। পরবর্তীতে আত্মরামের সেই কন্যা সন্তানই ইতিহাসের বিখ্যাত রানী ভবানী হসেবে ব্যাপক খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।

আরো কথিত আছে এই রানী ভবানীর জন্মের দিনেই সেই প্রাচীন গাছতলার নিচে যেখানে হিন্দুরা শিব লিংগের পূজা করতেন, সেখানো রানী ভবানী বড় হতে লাগলেন এবং গাছে পানি দিতেন ও যতœ নিতেন। এভাবেই একদিকে বড় হতে থাকেন রানী ভবানী, আর অন্যদিকে আরো বড় হতে থাকে গাছটি। সেই থেকে এখন পর্যন্ত এই গাছটি আকার আয়তনে বেড়েই চলেছে। আশপাশের কয়েক একর এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে সেই গাছ । গাছটির ঝুলন্ত লতা নেমে আরো অনেক গাছের সৃষ্টি হয়েছে। সেই সংখ্যাও কম নয়।

রানী ভবানীকে হিন্দু সম্প্রাদয়ের লোকেরা দেবী ভাবতেন। সে কারনে এই গাছটিকে ঘিরে এখনো পূজা অর্চণা হচ্ছে। অনেকে আবার মান্নত বা মনের আশা পূরনের জন্য এই গাছটিকে বেছে নেন। মুসলমানরা গাছটিকে বেশ উপকারী বৃক্ষ হিসেবে সমীহ করেন। যতœ নেন। কতবার গত ঝড় ঝাপ্টা গেছে অথচ এই গাছের আজ পর্যন্ত কোন ক্ষতি হয়নি এটাও একটা রহস্য হয়ে আছে গাছটির জন্য।

বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার ছতিয়ানগ্রামের বাজারে এই গাছটি এখনো কালের সাী হয়ে দাড়িয়ে আছে। রাস্তা জুড়ে গাছ থাকায় পথিকেরা এখানে বিশ্রাম নেন। আবার বৃ প্রেমিকরা এক নজর দেখার জন্য দুর-দুরান্ত থেকে ছুটে আসেন। অনেক দর্শনার্থী আসেন শুধু এই গাছ দেখার জন্য। মজার ব্যাপার হলো সেখানকার মায়েরা ছোট বাচ্চাদের এই গাছের গল্প বলতে বলতে ঘুমিয়ে দেন। ছোট বেলা থেকে এধরনের গল্প শুনতে শুনতে তাদের মধ্যে ভয়-ভীতিসহ নানা রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে । এই গাছ সম্পর্কে অনেকের অনেক রকম ধারনাও জন্মেছে।

গাছটি নিয়ে আরো অনেক ঘটনা আছে। গাছ তলায় একজন কামার কামারশালা বানিয়ে দীর্ঘকাল ধরে ব্যবসা করছেন। তিনি জানান, দাদার কাছে শুনেছি, আগে এই গাছের ডালপালা কাটা যেতো না। এমনকি ভয়ে কেউ পাতাও ধরতো না। যারা ডাল ভাঙতো তাদের অনেকের মুখ দিয়ে রক্ত উঠতো। এখনো অনেকে এই গাছের ডালপালা ভাঙ্গে না।

ছতিয়ানগ্রামের যুবক মামুন জানালেন, বছরে যখন গাছে ফল পেকে যায় তখন দারুন লাগে। লাল রংগে ছেয়ে যায় পুরো হাটের এই এলাকা।

গ্রামবাসীরা জানান, গাছে কেউ হাত না দিলেও গাছটিকে বাঁচানো দরকার। গাছটির পরিস্থিতি এখন আর আগের মতো নেই। তাছাড়া স্থানীয় নেশাগ্রস্থরা গাছের ডাল-পালা কেটে বিক্রি করে। তাই গাছটির অস্তিত্ব রক্ষায় সরকারের বনবিভাগের দৃষ্টি আকর্শন করেছেন এলাকাবাসি।

বিষয়: Contest_mother

২৮২৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File